ইন্দাস চুক্তি ভাঙা সম্ভব নয়: মোদির ঘোষণা বনাম বাস্তবতা

সম্প্রতি জম্মু–কাশ্মীরের পাহেলগামে একটি সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত–পাকিস্তানের সম্পর্ক নতুন করে উত্তেজনাপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ভারত সরকারের তরফে সিন্ধু নদীর পানি বণ্টন সংক্রান্ত ১৯৬০ সালের জল চুক্তি (ইন্দাস ওয়াটারস ট্রিটি) স্থগিতের ঘোষণা দেওয়া হয়। এর ফলে একাধিক প্রশ্ন উন্মোচিত হয়েছে— যেমন, চুক্তি অনুযায়ী ভারতের কী বাধ্যবাধকতা আছে, এবং মোদি সরকারের পক্ষে একপক্ষীয়ভাবে নদীর পানি বন্ধ বা কমানোর কোনো আইনি অধিকার আছে কি না। এই নিবন্ধে আমরা আন্তর্জাতিক আইন ও ইন্দাস চুক্তির আলোকে বিষয়গুলো বিশদে আলোচনা করব।
সিন্ধু জল চুক্তির ইতিহাস
ভারত–পাকিস্তানের মধ্যে পানির বণ্টন নিয়ে উত্তেজনা নতুন নয়। ১৯৪৭ সালে স্বাতন্ত্র্য লাভের পর থেকে উভয় দেশই সিন্ধু অববাহিকার চরম উপরের দেশে থাকায় পানি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল। এ অবস্থায় দীর্ঘ আলোচনা শেষে ১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বরে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় সই হয় ‘ইন্দাস ওয়াটারস ট্রিটি’। 당시 পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আয়ুব খানের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সংক্ষিপ্ত চুক্তির মাধ্যমে সই হয় এই জলচুক্তি। চুক্তিটি দক্ষিণ এশিয়ায় জলবণ্টন নিয়ে আন্তর্জাতিক সমঝোতার একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়।
চুক্তির মূল ধারাসমূহ
ইন্দাস ট্রিটি অন্তর্ভুক্ত ৬টি নদীর পানির বণ্টন নিয়ে। চুক্তি অনুযায়ী নদীগুলোকে পূর্বাঞ্চলীয় এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। সুনির্দিষ্টভাবে:
পূর্বাঞ্চলীয় তিন নদী – রাভি, বিয়াস ও সতলজ – এই তিনটি নদীর অধিকাংশ পানি ভারতের ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ।
পশ্চিমাঞ্চলীয় তিন নদী – সিন্ধু, ঝিলম ও চেনাব – এই তিন নদীর অধিকাংশ পানি পাকিস্তানের ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ।

চুক্তি ভারতকে সিন্ধু নদীর উপনদীগুলোতে সীমিত পরিসরে ড্যাম বা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয়, তবে কোনোভাবেই পাকিস্তানের দিকে চলমান পানির প্রবাহ সম্পূর্ণরূপে বাধাগ্রস্ত করার অধিকার দেয় না। অর্থাৎ, ভারতের উজানে নির্মিত কোনো অবকাঠামো যাতে নিচু অঞ্চলের পাকিস্তানে পানি পৌঁছতে বাধা না দেয়, সে বিষয় চুক্তি নিষ্পত্তিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
চুক্তিতে একতরফাভাবে বাতিল বা স্থগিত করার ধারাও নেই। বরং উভয়পক্ষের কোনো দ্বন্দ্ব বা বিবাদ দেখা দিলে তা আলোচনার মাধ্যমে বা চুক্তিতে উল্লেখিত প্রক্রিয়ায় (যেমন পার্মানেন্ট ইন্দাস কমিশন বা বিশ্বব্যাংকসহ মধ্যস্থতাকারী) সমাধানের নির্দেশনা দেওয়া আছে।
ভারতের আইনি বাধ্যবাধকতা
ইন্দাস জলচুক্তি একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত চুক্তি। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এই ধরনের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি দুই দেশের স্বাক্ষরিত এবং সুরক্ষা পাওয়া একটি বাধ্যতামূলক দলিল। সুতরাং চুক্তির কোনো শর্তকে একপক্ষীয়ভাবে ভঙ্গ করা বা পরিবর্তন করা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের শামিল হতে পারে। চুক্তিতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে কোনো দেশ একতরফাভাবে চুক্তি বাতিল বা স্থগিতের অধিকার পাবে না। অর্থাৎ, ভারত বা পাকিস্তান উভয়েরই সম্মতি বা নির্ধারিত বিরোধ সমাধান প্রক্রিয়া ছাড়া চুক্তিটি প্রভাববাহী অংশ কার্যত বাতিল করতে পারবে না।
আইনগত দিক থেকে দেখলে, ভারত সিন্ধু অববাহিকার তিনটি পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীতে (সিন্ধু, ঝিলম, চেনাব) ছোট পরিসরের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে পারবে, কিন্তু তারা পারবে না ঐ নদীগুলির পানি সম্পূর্ণরূপে আটকে দেওয়া বা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেওয়ার। অনানুষ্ঠানিক কোনো সাধারণ আন্তর্জাতিক নীতির কথাও এই চিত্রকে সমর্থন করে; কোনো শীর্ষদেশ নিজ চাহিদায় প্রতিবেশীর জল সম্পদের প্রবাহ বড় ধরনেরভাবে কমিয়ে দিতে পারে না।
পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের বাস্তবতা
চুক্তি ও আইন অনুযায়ী অনুমতি না পেলেও বাস্তবপক্ষে ভারতের ক্ষমতা মূল্যায়ন করাও জরুরি। সাম্প্রতিক বিশেষজ্ঞ মতের আলোকে দেখা গেছে, বর্তমানে ভারত সিন্ধু নদী ঘেঁষে পর্যাপ্ত বড় বাঁধ বা জলাধার তৈরি করেনি, ফলে পানির প্রবাহ পুরোপুরি বন্ধ করার সক্ষমতা তার হাতে নেই। তাছাড়া, এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসে হিমবাহের গলনো সময়কালে নিঃসৃত পানির পরিমাণ অত্যন্ত বেশি থাকে, যা বর্তমান গুদাম ক্ষমতার বাইরে। তাই আপাতত যদি চুক্তি স্থগিত থাকে তবুও ভারত স্বল্পমেয়াদে পাকিস্তানে প্রবাহিত পানি বন্ধ করতে পারবে না।
বিশেষজ্ঞরা জানান, যদি ভারত লক্ষ্য করে প্রবাহ সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করুক, তাতেও পাকিস্তানের কৃষিজলসেচনে মৌসুম ভিত্তিক কিছু সমস্যা হতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে বড় বাঁধ বা ড্যাম নির্মাণ ছাড়া একেবারেই পানি সরিয়ে রাখা কঠিন। সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে সরকারি ও জলবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা একমত হয়েছিলেন যে, “ভারত এই মুহূর্তে সিন্ধুর পানি প্রবাহ বন্ধ করতে পারবে না, কারণ চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তানকে যে তিনটি নদীর পানি দেওয়া হয়েছে, সেগুলোতে ভারত কোনো বড় স্টোরেজ বা বাঁধ তৈরি করেনি”।
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক উত্তেজনা নতুন মাত্রা পায়। এই ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের অধীন ভারতের নিরাপত্তা পরিষদ সিদ্ধান্ত নেয় সিন্ধু জলচুক্তির কার্যক্রম সাময়িক স্থগিত রাখার। পাকিস্তানের সরকারি মিডিয়াসহ গণমাধ্যমগুলো এই পদক্ষেপকে কড়া সমালোচনা করেছে। পাকিস্তান সরকার আশংকা প্রকাশ করেছে যে ইন্দাস জলচুক্তি ভঙ্গ করে যদি ভারত সিন্ধু নদীর পানি আটকে দেয়, তাহলে এটিকে ‘যুদ্ধের উসকানি’ বা ‘যুদ্ধের কর্মকাণ্ড’ হিসেবে গণ্য করা হবে। উদাহরণস্বরূপ, একটি প্রতিবেদন উল্লেখ করে, “পানি বন্ধ করার যেকোনো প্রচেষ্টা যুদ্ধের উসকানি হিসেবে বিবেচিত হবে”। অনুরূপভাবে, পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রক জানায় যে তাদের ন্যায্য পানির প্রবাহ বন্ধ বা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার কোনো চেষ্টা “যুদ্ধের কর্মকাণ্ড” বলে গণ্য হবে।
এদিকে উভয়পক্ষই সীমান্তে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে এবং পরস্পরের ওপর কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করেছে। ভারত সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করে দিয়েছে, পাকিস্তান ভারতীয় নাগরিকদের জন্য দেওয়া সব ভিসা বাতিল করেছে, এমনকি ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তি স্থগিত করার মতো পদক্ষেপ নিয়েছে। এসব কূটনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে বাস্তুসংস্থাপন নিয়ন্ত্রণ না থাকলে ইন্দাস নদের সমস্যা দ্বিপক্ষীয় বিবাদকে আরও বাড়াতে পারে।
সংক্ষেপে,
আন্তর্জাতিক আইন এবং ১৯৬০ সালের সিন্ধু জলচুক্তি উভয়ই ভারতকে একপক্ষীয়ভাবে সিন্ধু নদীর পানি আটকানোর অধিকার দিচ্ছে না। চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে প্রায় ৬৫ বছর ধরে এটিকে যথেষ্ট সাফল্যপূর্ণভাবে মানা হয়েছে। চুক্তিতে পরিষ্কারভাবে বলা আছে যে কোনো পক্ষই একতরফায় চুক্তি বাতিল বা স্থগিত করতে পারবে না এবং যে কোনো বিবাদ হলে সেটি আলোচনা বা নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় সমাধান করতে হবে। এর বাইরে ভারতে পর্যাপ্ত বড় বাঁধ না থাকায় ফিজিক্যালি পূর্ণ মাত্রায় পাকিস্তানের পানি বন্ধ করাও সম্ভব নয়। অতএব, মোদি সরকারের চুক্তি স্থগিতের সিদ্ধান্ত যুদ্ধ ও কূটনৈতিক উত্তেজনার প্রকাশ, কিন্তু চুক্তির বাধ্যবাধকতাকে তাতক্ষণিকভাবে শিথিল করে না। চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তানের পানি সরবরাহ নিশ্চিত রাখতে ভারতকে আন্তরিকভাবে সম্মতি মেনে চলতে হবে।
উল্লেখিত তথ্যসূত্র: সিন্ধু জলচুক্তি ও সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ থেকে।