জাতীয় খবর

ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ গেল মায়ের


আম পাড়াকে কেন্দ্র করে রক্তাক্ত সংঘর্ষ, ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ গেল মায়ের

📍 ঝিনাইদহ | প্রতিনিধিঃ প্রতিদিন সকাল

ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার একটি গ্রামে আম পাড়াকে কেন্দ্র করে এক হৃদয়বিদারক ঘটনার জন্ম হয়েছে। মাত্র ১৪ বছরের ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে নিহত হয়েছেন তার মা। এই মর্মান্তিক ঘটনায় এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সোমবার বিকেলে উপজেলার কচুয়াপাড়া গ্রামে দুই পরিবারের মধ্যে আমগাছ থেকে আম পাড়া নিয়ে তীব্র কথা-কাটাকাটি শুরু হয়। এক পর্যায়ে তা রূপ নেয় ভয়াবহ সংঘর্ষে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, লাঠি-সোটা হাতে জড়ো হয় উভয় পক্ষের লোকজন।

আম গাছ থেকেই ঘটনার সূচনা

গ্রামের মোড়ে একটি পুরোনো আমগাছ আছে, যেটি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই দুই পরিবারের মধ্যে মালিকানা নিয়ে বিরোধ চলছিল। সোমবার দুপুরে গাছের নিচে খেলছিল সাকিব (১৪)। তখনই সে গাছ থেকে কয়েকটি পাকা আম পেড়ে নেয়। বিষয়টি নজরে পড়ে প্রতিবেশী করিম মাস্টারের ছেলের। এরপরই শুরু হয় উত্তেজনা।

শুধুমাত্র একটি আম পাড়াকে কেন্দ্র করেই প্রথমে শুরু হয় তর্কাতর্কি। করিম মাস্টারের পরিবারের দাবি, গাছটি তাদের পূর্বপুরুষের লাগানো, সুতরাং আম পাড়ার অধিকারও তাদের। অপরদিকে সাকিবের মা রওশন আরা বেগম বলেন, “এই গাছ আমাদের ভিটায় পড়েছে, তাই আম পাড়াতে কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়।”

শব্দ বাড়তেই হামলার ঘটনা

বিকেল ৪টার দিকে তর্কাতর্কি যখন চরমে, তখন করিম মাস্টারের ছেলে নাঈম (১৮) ও তার কয়েকজন বন্ধু এসে সাকিবকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। খবর পেয়ে ছুটে আসেন সাকিবের মা রওশন আরা। তিনি এসে ছেলেকে মারধর থেকে বাঁচাতে গেলে বিপত্তি ঘটে। অভিযোগ রয়েছে, নাঈমের হাতে থাকা লাঠির বাড়ি সরাসরি লাগে রওশন আরার মাথায়। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।

গ্রামবাসী জানায়, মারাত্মক আঘাতে ঘটনাস্থলেই জ্ঞান হারান রওশন আরা। তাকে তাৎক্ষণিকভাবে শৈলকুপা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল ঘটনাটি

এই মর্মান্তিক ঘটনার ভিডিও এবং ছবি ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ‘একটি আমের জন্য একটি প্রাণ ঝরে গেল’—এই শিরোনামে ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামে চলছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। অনেকেই বলছেন, “কৃষিভিত্তিক সমাজে এমন মূর্খতা বেমানান”।

গ্রামজুড়ে শোকের ছায়া

ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ গেল মায়ের

রওশন আরা বেগম ছিলেন এলাকার একজন সমাজসেবী নারী। তার মৃত্যুতে শুধু পরিবার নয়, সমগ্র গ্রাম শোকাহত। স্থানীয় স্কুলশিক্ষক মহিউদ্দিন বলেন, “তিনি ছিলেন খুবই নম্র ও হৃদয়বান একজন মানুষ। এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।”

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা

শৈলকুপা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রতন মিয়া বলেন, “ঘটনার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে অভিযুক্ত নাঈম ও তার বন্ধুদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। আমরা অভিযান চালিয়ে নাঈমকে গ্রেপ্তার করেছি। বাকিদের ধরতে অভিযান চলছে।”

ওসি আরও জানান, ঘটনার ভিডিও ফুটেজ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রাথমিক তদন্তে হত্যার আলামত মিলেছে। নিহতের পরিবারকে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের প্রতিক্রিয়া

ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল হালিম প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “একটা আম নিয়ে এমন ভয়াবহ ঘটনা সত্যিই দুঃখজনক। আমরা দুই পরিবারকে আগেও বোঝানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু কেউ শোনেনি। এখন প্রাণ গেল, কে ফিরিয়ে দেবে?”

তিনি বলেন, “আমি প্রশাসনের কাছে জোর দাবি জানাব, যাতে অপরাধীরা কঠোর শাস্তি পায় এবং এমন ঘটনা আর কখনও না ঘটে।”

একটি আম, এক মহামূল্যবান প্রাণ

দেশের গ্রামবাংলায় গাছপালা, জমিজমা নিয়ে বিবাদ নতুন কিছু নয়। তবে আধুনিক যুগে এসেও শুধুমাত্র একটি আমের কারণে একজন মা প্রাণ হারাবেন—এটা ভাবতেই অবাক লাগে। এমন ঘটনায় সমাজের সার্বিক অবক্ষয়ের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে বলে মনে করছেন সমাজবিদগণ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সানাউল্লাহ হক বলেন, “পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষার অভাব, আইনের শাসনের দুর্বলতা এবং সহনশীলতার অভাব—এই তিনটি বিষয়ের সম্মিলিত প্রতিফলন আমরা দেখছি এই ঘটনার মধ্যে।”

নিহত রওশন আরার স্বামী হুমায়ুন কবির দাবি জানিয়েছেন, “আমার স্ত্রীর কোনো দোষ ছিল না। সে শুধুমাত্র তার ছেলেকে বাঁচাতে গিয়েছিল। আমি সরকারের কাছে অনুরোধ জানাই, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক এবং আমাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক।”

এই ঘটনা আমাদের সমাজের সামগ্রিক মূল্যবোধ, সহনশীলতা ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধার অভাবকেই তুলে ধরে। প্রতিটি মানুষের উচিত পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহানুভূতির ভিত্তিতে সমাজ গঠন করা। একটুখানি সহনশীলতা হয়তো বাঁচাতে পারত একটি প্রাণ, একটি সংসার, একটি ভবিষ্যৎ।


আমরা প্রতিনিয়তই দেখি ছোট্ট বিষয় নিয়ে বিশাল অঘটন। পারিবারিক দ্বন্দ্ব, সম্পত্তি বা ফলমূল নিয়ে মারামারি, শেষ পর্যন্ত প্রাণহানিতে রূপ নেয়—যেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। প্রশাসন, সমাজ, পরিবার সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এই ধরনের সহিংসতা রোধে। ছোটদের শিক্ষা দিতে হবে সহনশীলতার, বড়দের উচিত হবে তা অনুশীলনে পরিণত করা।


🔴 আপনারা দেখছেন প্রতিদিন সকাল।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *