Site icon প্রতিদিন সকাল

ইতালির ফিরেন্স: এক রহস্যময় শিল্প-নগরীর অজানা গল্প

ইতালির ফিরেন্স: এক রহস্যময় শিল্প-নগরীর অজানা গল্প

ইতালির ফিরেন্স: এক রহস্যময় শিল্প-নগরীর অজানা গল্প

ইতালির এক রহস্যময় শিল্প

রেনেসাঁর জন্মভূমি, অথচ লুকানো অন্ধকার

ইতালির ফিরেন্স শহরটিকে বলা হয় ইউরোপীয় রেনেসাঁর আঁতুড়ঘর। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, মাইকেলেঞ্জেলো, গ্যালিলিওর মতো কিংবদন্তিরা এই শহরেই তাদের সৃষ্টিশীলতার পত্তন ঘটিয়েছেন। কিন্তু আপনি জানেন কি, এই শহরের বুকে বহু বছর ধরে লুকিয়ে আছে অজানা রহস্য, অদ্ভুত ঘটনা আর ইতিহাসের অন্ধকার অধ্যায়?

চলুন জেনে নিই ফিরেন্স শহরের কিছু চমকে দেওয়া, রহস্যে মোড়ানো কাহিনি—যা সাধারণ পর্যটকের চোখে পড়ে না।


১. ‘দ্য সিক্রেট করিডর’ — রাজপরিবারের গোপন রাস্তা

১৫৬৫ সালে মেডিচি পরিবার ফিরেন্সের রাজনীতির শীর্ষে ছিল। সেই সময়ে গ্র্যান্ড ডিউক কসমো ডি মেডিচি এমন একটি গোপন করিডর নির্মাণ করেন, যা পিট্টি প্যালেস থেকে উফিজি গ্যালারি হয়ে পলাজ্জো ভেকিও পর্যন্ত গোপনে চলাচল করতে সাহায্য করতো রাজপরিবারকে।

এই করিডরের নাম Vasari Corridor। এটি আজও সাধারণের জন্য পুরোপুরি উন্মুক্ত নয়। ধারণা করা হয়, এই করিডরে লুকানো আছে শতাব্দীপ্রাচীন শিল্পকর্ম, এমনকি এমন কিছু গোপন চিহ্ন, যা রেনেসাঁ যুগের ধর্ম ও রাজনীতির গোপন সম্পর্ক উন্মোচন করতে পারে।


২. ‘দ্য কার্সড উইন্ডো’ — অভিশপ্ত জানালার রহস্য

ফিরেন্সের পিয়াজ্জা দেলা স্যান্টিসিমা আনুনজিয়াতা চত্বরে রয়েছে একটি অদ্ভুত জানালা। স্থানীয়রা একে ডাকে “ফিনেস্ট্রা মলেডেত্তা” অর্থাৎ অভিশপ্ত জানালা।

শোনা যায়, বহু শতাব্দী আগে একজন মহিলা এই জানালার পাশে তার স্বামীর মৃত্যুর খবর পান। তারপর তিনি দিনের পর দিন জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতেন, স্বামীর ফেরার আশায়। মৃত্যুর আগে তার শেষ ইচ্ছা ছিল—”এই জানালাটা কখনো বন্ধ করা যাবে না।”

বেশ কয়েকবার জানালাটি বন্ধ করার চেষ্টা করা হলেও প্রতিবারই রহস্যময়ভাবে সেটি খোলা পাওয়া গেছে! অনেকে বিশ্বাস করেন, মহিলার আত্মা এখনও জানালার পাশে বসে অপেক্ষা করছেন।


৩. গ্যালিলিওর মৃত্যুর পরে তার দেহ নিয়ে গোপন পরিকল্পনা

বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলেই মৃত্যুর পর চার্চ তাকে পবিত্র সমাধিস্থানে কবর দিতে অস্বীকৃতি জানায়, কারণ তিনি পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে এই মতবাদ প্রচার করেছিলেন।

তবে ৯৫ বছর পর গোপনে তার দেহ ফিরেন্সের সান্তা ক্রোচে গির্জায় এনে কবর দেওয়া হয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, তার সমাধিস্থানের সময় কিছু মানুষ গ্যালিলিওর আঙুল কেটে রেখে দেয় ‘ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীদের জন্য’। আজ সেই আঙুল সজ্জিতভাবে প্রদর্শিত হয় মিউজিয়ামে!


৪. উফিজি গ্যালারির লুকানো বার্তা

বিশ্বখ্যাত উফিজি গ্যালারিতে আছে হাজারো রেনেসাঁ চিত্রকর্ম। তবে ইতিহাসবিদরা দাবি করেন, কিছু চিত্রের মধ্যে গোপন বার্তা ও সাংকেতিক চিত্র ব্যবহার করেছেন শিল্পীরা। বিশেষ করে বটিচেল্লির ‘দ্য বার্থ অব ভেনাস’ চিত্রে রয়েছে জ্যোতির্বিদ্যার সংকেত ও রাজনীতিক ইঙ্গিত।

তথ্য অনুসারে, এই চিত্রের মাধ্যমে গোপনে ‘মেডিচি পরিবারকে’ দেবতাদের মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। কেউ কেউ বলেন, এই ধরনের সাংকেতিক চিত্র ব্যবহার করে তৎকালীন ক্ষমতাবানরা সাধারণ জনগণের উপর প্রভাব বিস্তার করতো।


৫. রহস্যময় অদৃশ্য বইঘর — ‘দ্য লস্ট লাইব্রেরি অফ লরেঞ্জো’

লরেঞ্জো দ্য মেডিচি ছিলেন একজন মহৎ পাঠক ও সংগ্রাহক। তিনি এমন একটি লাইব্রেরি তৈরি করেছিলেন যেখানে রোমান, গ্রিক, আরবি, হিব্রু ভাষায় রচিত প্রাচীন গ্রন্থের বিশাল সংগ্রহ ছিল।

কিন্তু সময়ের স্রোতে সেই লাইব্রেরির মূল সংগ্রহের বেশিরভাগ অংশ আধুনিক ফিরে পাওয়া যায়নি। অনেকে বিশ্বাস করেন, এই ‘লস্ট লাইব্রেরি’ এখনও কোথাও লুকিয়ে আছে ফিরেন্স শহরের নিচে কোনো গোপন কক্ষে। সেখানে এমন কিছু প্রাচীন জ্ঞান লুকিয়ে থাকতে পারে, যা আজকের বিজ্ঞানের সীমাকেও ছাড়িয়ে যাবে!


৬. মাইকেলেঞ্জেলোর গোপন আঁকা — “ডেভিডের পেছনে লুকানো রহস্য”

বিশ্বখ্যাত ভাস্কর্য “ডেভিড” যেটি মাইকেলেঞ্জেলো তৈরি করেন, তা শুধু একটি শিল্প নয়, বরং একটি সাংকেতিক বার্তা।

গবেষকরা বলেন, ডেভিডের চোখের দৃষ্টি ও শরীরের কাঠামো এমনভাবে তৈরি, যেন সেটি যুদ্ধের প্রস্তুতির মুহূর্তকে বোঝায়। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো—মাইকেলেঞ্জেলো গোপনে নিজের নাম এই মূর্তির ভিতরে এক গোপন স্থানে খোদাই করে রেখেছিলেন, যা ১৯৯০-এর দশকে এক্স-রে স্ক্যানের মাধ্যমে আবিষ্কৃত হয়।


৭. ফিরেন্স শহরের নিচে লুকানো আরেক শহর!

ফিরেন্সের মাটির নিচে আছে এক ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাচীন শহর, যার নাম Florentia। রোমান সাম্রাজ্যের সময়কালে এই শহর ছিল মূল নগরকেন্দ্র।

বর্তমান ফিরেন্সের নিচে এখনো রয়েছে সেই প্রাচীন রোমান রাস্তাঘাট, থিয়েটার, স্নানঘর ইত্যাদির ধ্বংসাবশেষ। অনেক গবেষক বিশ্বাস করেন, সেখানে এখনও এমন কিছু গোপন গুহা ও রাস্তা আছে, যা পুরনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও রাজনীতির সাক্ষ্য বহন করে।


শেষ কথা

ফিরেন্স শুধু রেনেসাঁ যুগের আলো নয়, বরং এটি এক রহস্যময় ইতিহাসের মঞ্চ। এখানে প্রতিটি দেয়াল, অলিগলি, ভাস্কর্য আর শিল্পকর্মের পেছনে লুকিয়ে আছে শতাব্দীজুড়ে বিস্ময়কর কাহিনি।

এই শহর শুধু দর্শনীয় নয়, বরং এটি এক জীবন্ত ইতিহাস গ্রন্থ—যার প্রতিটি পৃষ্ঠা খুললে বেরিয়ে আসে একেকটি অজানা অধ্যায়।


#Florence #FirenzeMystery #ইতালির_রহস্য #প্রতিদিনসকাল #PratidinSokal

আপনারা দেখছেন প্রতিদিন সকাল।


Exit mobile version